কফি আপনার ওষুধের কার্যকারিতায় প্রভাব ফেলছে না তো?

প্রতিটি মানুষ ক্যাফেইনকে ভিন্নভাবে গ্রহণ করে। কেউ তিন কাপ কফির পরেও স্বাভাবিক থাকেন, আবার কেউ এক কাপ খেলেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভোগেন।
আমাদের অনেকের এক কাপ কফি ছাড়া দিন শুরু হয় না। এটি আরামদায়ক, উদ্দীপক এবং বিশ্বের সবচেয়ে বেশি খাওয়া পানীয়গুলোর একটি। তবে আপনার সকালের এই প্রিয় পানীয়টি নিরীহ মনে হলেও এটি কিছু ওষুধের সঙ্গে মিশে তাদের কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
সাধারণ ঠাণ্ডার ওষুধ থেকে শুরু করে বিষণ্ণতার ওষুধ পর্যন্ত ক্যাফেইনের শরীরের ওপর প্রভাব অনেক গভীর। চা-তেও ক্যাফেইন থাকে, তবে কফির তুলনায় কম, এবং এটি ততটা প্রভাবও ফেলে না। নিচে তুলে ধরা হলো কিভাবে কফি আপনার ওষুধের সঙ্গে প্রভাব ফেলতে পারে এবং আপনি কিভাবে নিরাপদে থাকতে পারেন।
১. ঠাণ্ডা ও ফ্লুর ওষুধ
ক্যাফেইন একটি স্টিমুল্যান্ট, অর্থাৎ এটি স্নায়ুতন্ত্রকে উদ্দীপিত করে। ঠাণ্ডার ওষুধে থাকা সিউডোইফেড্রিন (যেমন সিউডোফেড) একইভাবে উদ্দীপক, ফলে কফির সঙ্গে একসঙ্গে নিলে প্রভাব দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে যেমন উত্তেজনা, ঘুম না হওয়া, মাথাব্যথা, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।
কিছু ঠাণ্ডার ওষুধে ক্যাফেইন যোগ করাই থাকে, এতে ঝুঁকি আরও বাড়ে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, সিউডোইফেড্রিন ও ক্যাফেইন একসঙ্গে নিলে রক্তে শর্করা ও শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য চিন্তার বিষয়। এ ধরনের স্টিমুল্যান্ট প্রতিক্রিয়া এডিএইসডি-এর ওষুধ (যেমন অ্যামফেটামিন) ও হাঁপানির ওষুধ (যেমন থিওফাইলিন) এর ক্ষেত্রেও দেখা যায় যা ক্যাফেইনের মতো গঠনে। একসঙ্গে নিলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
২. থাইরয়েডের ওষুধ
লেভোথাইরক্সিন, যা হাইপোথাইরয়েডের ওষুধ, এটি সময় অনুযায়ী সঠিকভাবে খেতে হয়। আর কফি খাওয়া এর কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই ওষুধ খাওয়ার পর কফি খেলে এর শোষণ ৫০% পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
ক্যাফেইন হজমনালীতে খাবারের গতি বাড়ায়, ফলে ওষুধ শোষণের সময় কমে যায় এবং ক্যাফেইন নিজেই ওষুধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তা শরীরে কম পৌঁছায়। এর ফলে হাইপোথাইরয়েডের উপসর্গ (যেমন ক্লান্তি, ওজন বাড়া, কোষ্ঠকাঠিন্য) ফিরে আসতে পারে। একই নিয়ম অস্টিওপরোসিসের ওষুধ (যেমন আলেনড্রোনেট, রাইসেড্রোনেট)-এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
৩. মানসিক স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট ওষুধ
ক্যাফেইন ও মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ওষুধের সম্পর্ক আরও জটিল। এসএসআরআই (যেমন সেরট্রালিন, সিটালোপ্রাম) ধরণের ওষুধের শোষণ কমিয়ে দিতে পারে ক্যাফেইন, ফলে ওষুধের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে।
ট্রাইসাইক্লিক অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট (যেমন অ্যামিট্রিপটাইলিন, ইমিপ্রামিন)-এর ভাঙন ঘটে লিভারের এনজাইম CYP1A2 দ্বারা যেটি ক্যাফেইনের ক্ষেত্রেও কাজ করে। এতে ওষুধের গতি কমে যেতে পারে বা ক্যাফেইন শরীরে বেশি সময় থেকে যেতে পারে।অ্যান্টিসাইকোটিক ক্লোজাপিনও এই এনজাইম দ্বারা ভাঙে। গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে দুই থেকে তিন কাপ কফি খেলে ক্লোজাপিনের মাত্রা ৯৭% পর্যন্ত বাড়তে পারে যা ঘুম ঘুম ভাব, বিভ্রান্তি বা জটিলতা তৈরি করতে পারে।
৪. ব্যথানাশক ওষুধ
কিছু ব্যথানাশক (যেমন প্যারাসিটামল বা অ্যাসপিরিন) -এ ক্যাফেইন মেশানো থাকে। ক্যাফেইন পাকস্থলীর গতি বাড়িয়ে ও অ্যাসিড বাড়িয়ে এই ওষুধগুলোর শোষণ ত্বরান্বিত করতে পারে। যদিও এতে ওষুধ দ্রুত কাজ করতে পারে, তবে পেটের জ্বালা বা রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়ে, বিশেষ করে অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণে।
৫. হৃদরোগের ওষুধ
ক্যাফেইন সাময়িকভাবে রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন বাড়াতে পারে যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ বা অনিয়মিত হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধের কার্যকারিতায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে এর মানে এই নয় যে হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কফি পুরোপুরি বাদ দিতে হবে বরং উপসর্গ দেখলে ক্যাফেইনের পরিমাণ কমানো বা ডিক্যাফ কফি গ্রহণ করার কথা ভাবতে পারেন।
কীভাবে নিরাপদে কফি খাবেন:
* লেভোথাইরক্সিন বা অস্টিওপরোসিসের ওষুধ খাওয়ার পর অন্তত ৩০-৬০ মিনিট পরে কফি বা নাশতা খান।
* ঠাণ্ডা, হাঁপানি বা এডিএইসডি-এর ওষুধ খেলে অতিরিক্ত ক্যাফেইন থেকে সতর্ক থাকুন।
* মানসিক স্বাস্থ্য বা রক্তচাপের ওষুধ খেলে আপনার ক্যাফেইন অভ্যাস নিয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
* যদি অস্থিরতা, ঘুম না হওয়া বা হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়ার মত উপসর্গ দেখা যায় – তবে ক্যাফেইন কমান বা ডিক্যাফ বেছে নিন।
সবাই ক্যাফেইন ভিন্নভাবে সহ্য করে কারো তিন কাপেও কিছু হয় না, কারো এক কাপেই সমস্যা হয়। নিজের শরীরের প্রতিক্রিয়া খেয়াল রাখুন এবং সন্দেহ হলে চিকিৎসক বা ফার্মাসিস্টের পরামর্শ নিন।