সামরিক কুচকাওয়াজ নতুন অস্ত্রে শক্তি দেখাল চীন

বেইজিংয়ের তিয়ানআনমেন স্কয়ারে চীনের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সামরিক কুচকাওয়াজে বিশ্বকে শান্তি ও সংলাপের পথে হাঁটার আহবান জানিয়েছেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং। অনুষ্ঠানে তাঁর পাশে ছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন। এ সময় চীনের অগ্রযাত্রা থামানো যাবে না বলেও মন্তব্য করেন প্রেসিডেন্ট চিনপিং। গতকালের অনুষ্ঠানে চীন আরেকটি বিষয় পরিষ্কার করে দিয়েছে।
সেটি হলো সামরিক শক্তি হিসেবে চীন ভারতের চেয়ে উত্তর কোরিয়াকেই বেশি গুরুত্ব দেয়।
বুধবার বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক কুচকাওয়াজে প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং সতর্ক করে বলেন, বিশ্ব এখন শান্তি নাকি যুদ্ধ—এই মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে জাপানের পরাজয়ের ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এই বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফও উপস্থিত ছিলেন। তবে পশ্চিমা কোনো দেশের কোনো দেশের নেতা এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না।
শি চিনপিংয়ের পাশাপাশি অতিথি হিসেবে কুচকাওয়াজে উপস্থিত ছিলেন ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পশ্চিমাদের চোখে একঘরে হয়ে পড়া পুতিন ও পারমাণবিক কর্মসূচির জন্য সমালোচিত কিম।
নতুন অস্ত্রে শক্তি দেখাল চীনশি চিনপিং বলেন, ‘আজ মানবজাতি শান্তি নাকি যুদ্ধ, সংলাপ নাকি সংঘাত, পারস্পরিক লাভ নাকি শূন্য—সমীকরণের মধ্যে একটির পথ বেছে নেবে। চীনা জনগণ ইতিহাসের সঠিক পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।’
এর আগে খোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে শি চিনপিং সেনাদের সালাম গ্রহণ করেন এবং মিসাইল, ট্যাংক, অত্যাধুনিক লেজার অস্ত্র, ড্রোনসহ আধুনিক সামরিক সরঞ্জাম পরিদর্শন করেন।
আকাশে হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমানের মহড়া চলে। ৭০ মিনিটের এই শোভাযাত্রা শেষে আকাশে ওড়ানো হয় ৮০ হাজার শান্তির কবুতর ও রঙিন বেলুন।
মাও জেদংয়ের ধাঁচে তৈরি পোশাক পরে প্রেসিডেন্ট চিনপিং লাল কার্পেটে ২০টিরও বেশি দেশের নেতাদের স্বাগত জানান। এর মধ্যে ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তোও। নিজের দেশে ব্যাপক বিক্ষোভের মধ্যেও হঠাৎ অনুষ্ঠানে হাজির হন তিনি।
মঞ্চে শি চিনপিংয়ের দুই পাশে বসেন পুতিন ও কিম। একাধিকবার তাঁদের সঙ্গে আলাপও করেন তিনি। শি চিনপিং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে চীনের ‘মহান পুনর্জাগরণের বাঁক’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, জাপানি আগ্রাসন থেকে উঠে এসে চীন এখন অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক শক্তি। তিনি আবারও ‘শক্তির রাজনীতি ও আধিপত্যবাদ’-এর বিরুদ্ধে ঐক্যের আহবান জানান। যুক্তরাষ্ট্রকে লক্ষ্য করে পরোক্ষভাবে তিনি এই ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই আয়োজন শুধু সামরিক শক্তি প্রদর্শন নয়, বরং ঘরে-বাইরে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলার কৌশলও। একই সঙ্গে এটি রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনারও ইঙ্গিত বহন করে। বিশ্লেষকরা নজর রাখছেন, এই ত্রয়ী নতুন প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ইঙ্গিত দেয় কি না। জুন ২০২৪-এ রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে স্বাক্ষরিত প্রতিরক্ষা চুক্তি এবং বেইজিং-পিয়ংইয়ংয়ের সম্ভাব্য জোট এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সামরিক ভারসাম্য পাল্টে দিতে পারে।
এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের বিরুদ্ধে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার দুই শীর্ষ নেতাকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছেন। ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া পোস্টে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘প্লিজ ভ্লাদিমির পুতিন ও কিম জং উনকে আমার উষ্ণ শুভেচ্ছা পৌঁছে দিন, যখন আপনারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন।’
কুচকাওয়াজ পরিদর্শনের জন্য বেইজিংয়ে আমন্ত্রিত ২৬ জন রাষ্ট্রনেতার নামের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে চীনের স্টেট কাউন্সিল। তাঁদের মধ্যে আছেন ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট লুয়ং কুয়ং, বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান, জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট এমারসন মনানগাগওয়া, সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার ভুচিচ, কিউবার প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল দিয়াজ ক্যানেল। তালিকায় আরো আছেন মায়ানমারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট মিন অং হ্লাইং, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ, শ্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকো প্রমুখ রাষ্ট্রনেতার নাম।
এটি একটি অত্যন্ত প্রতীকী শীর্ষ সম্মেলন, যা মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার বিরোধী একটি বিকল্প ব্লকের নেতা হিসেবে বেইজিংয়ের ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এই শীর্ষ সম্মেলন চীনকে এই জোটের কেন্দ্রীয় নেতার মর্যাদা দিয়েছে, যা মূলত বিদ্যমান আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলাকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করার ইচ্ছার ইঙ্গিত দিচ্ছে। সূত্র : রয়টার্স, মডার্ন ডিপ্লোমেসি