লালসবুজ২৪.কম
রেল ধ্বংসের নকশাকার: বাস মালিকদের দোসর বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) মাহবুব

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২৫, ০৪:৫২ পিএম

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ রেলওয়ের বর্তমান পরিস্থিতি সংকটাপন্ন। দেশে রেল যোগাযোগের জন্য প্রয়োজনীয় ইঞ্জিন এবং মেকানিক্যাল যন্ত্রপাতির সংকট ক্রমেই গভীর হচ্ছে। যান্ত্রিক বিভাগের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি-আরএস) আহমেদ মাহবুবের কার্যক্রমের কারণে এই সংকট আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।

অভিযোগ রয়েছে, তিনি ইঞ্জিন এবং মেরামতের যন্ত্রাংশ ক্রয় প্রক্রিয়া এক বছর ধরে বন্ধ করে রেখেছেন, যা রেল ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ ছাড়া, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে বাস মালিকদের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে রেলকে দুর্বল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের বর্তমান পরিস্থিতি সংকটাপন্ন। দেশে রেল যোগাযোগের জন্য প্রয়োজনীয় ইঞ্জিন এবং মেকানিক্যাল যন্ত্রপাতির সংকট ক্রমেই গভীর হচ্ছে। যান্ত্রিক বিভাগের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি-আরএস) আহমেদ মাহবুবের কার্যক্রমের কারণে এই সংকট আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি ইঞ্জিন এবং মেরামতের যন্ত্রাংশ ক্রয় প্রক্রিয়া এক বছর ধরে বন্ধ করে রেখেছেন, যা রেল ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ ছাড়া, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে বাস মালিকদের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে রেলকে দুর্বল করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

রেলওয়ে প্রশাসনের কিছু সূত্রের মতে, মাহবুবের এই পদক্ষেপের পেছনে একটি গোপন উদ্দেশ্য রয়েছে—বর্তমান মহাপরিচালককে ব্যর্থ প্রমাণ করা এবং নিজে ডিজি পদে বসার সুযোগ তৈরি করা। একাধিক অভিযোগে বলা হচ্ছে, তিনি বাস মালিকদের সাথে আঁতাত করে রেল ব্যবস্থার দুর্বলতা আরও বাড়ানোর চেষ্টা করছেন, যাতে রেলপথের কার্যক্রম ব্যাহত হয় এবং বাস ব্যবসার আধিপত্য বৃদ্ধি পায়।

দৈনন্দিন কার্যক্রমের বিপর্যয়:বর্তমানে রেলওয়ের দৈনন্দিন কার্যক্রম বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শতাধিক ইঞ্জিন অকেজো হয়ে পড়ে আছে কারখানায়, এবং চলমান ইঞ্জিনগুলোকে একাধিক ট্রেনে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ফলে প্রতিদিনই নতুন ইঞ্জিন বিকলের ঘটনা ঘটছে।

অতীতের ব্যর্থতা: পিডি হিসেবেই ধ্বংস

৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন সংগ্রহের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ছিলেন আহমেদ মাহবুব। টানা ছয় বছর এই প্রকল্পের দায়িত্বে থেকেও তিনি কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখাতে পারেননি। বরং, প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন ব্যর্থ প্রকল্প পরিচালকের হাতে যান্ত্রিক বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তুলে দেওয়া রেলের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।

অথচ এডিজি-আরএস পদে বসানোর মতো সবচেয়ে যোগ্য ও মেধাবী একজন কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও তাঁকে পদায়ন দেওয়া হয়নি। বরং তাঁকে কম গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্পের দায়িত্বে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, রেল ধ্বংসের কারিগর মাহবুব ও তাঁর সিন্ডিকেট ওই যোগ্য কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করাচ্ছে, যাতে তাঁকে দুর্বল ও অযোগ্য প্রমাণ করা যায়।

সিদ্ধান্তহীনতা ও ফাইল ঝুলিয়ে রাখার কৌশল:

এডিজি-আরএস পদে থেকেও মাহবুবের অযোগ্যতা স্পষ্ট। অভিযোগ রয়েছে, তিনি নিজে কোনো ফাইলে সিদ্ধান্ত দেন না। বরং তাঁর অধস্তন দুই কর্মকর্তা ও রেলের অবসরপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তার মতামতের উপর নির্ভর করেন। যদি তারা কোনো ফাইলে ইতিবাচক মতামত দেন, তবে তিনি স্বাক্ষর করেন; অন্যথায় অযৌক্তিক ও উদ্ভট তথ্য চেয়ে ফাইল ফেরত পাঠান।

ফলে গুরুত্বপূর্ণ ফাইলগুলো মাসের পর মাস ঝুলে থাকে, নতুন কোনো প্রকল্প বা যন্ত্রপাতি ক্রয়ের কাজ এগোয় না। এতে সরাসরি লাভবান হচ্ছেন বাস মালিকরা, আর রেলওয়ে প্রতিদিনই আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে। বর্তমানে শতাধিক ইঞ্জিন অকেজো হয়ে পড়ে আছে কারখানায়। যে ইঞ্জিনগুলো সচল আছে, সেগুলোকে একাধিক ট্রেনে ব্যবহার করতে হচ্ছে। ফলে প্রতিদিনই নতুন ইঞ্জিন বিকল হচ্ছে।

• পূর্বাঞ্চল: এখানে দৈনিক ইঞ্জিনের চাহিদা ১১৬টি, কিন্তু সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ১০০টি, ফলে প্রতিদিন ১৬টি ইঞ্জিনের অভাব দেখা দিচ্ছে। কিন্তু হাতে থাকে মাত্র ৫৫-৬০ টি ইঞ্জিন।

• পশ্চিমাঞ্চল: এই অঞ্চলে দৈনিক চাহিদা ১০০টির বেশি, কিন্তু সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ৮৭টি, যার ফলে ট্রেন চলাচলে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু হাতে থাকে মাত্র ৬০-৬৫টি ইঞ্জিন।

লোকোমোটিভ বিকল ও যান্ত্রিক সমস্যা:

ট্রেনের মাঝপথে লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) বিকলের ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ছে, এবং চালকরা উদ্বেগের মধ্যে ট্রেন চালাচ্ছেন। বিশেষ করে, মিটারগেজ ইঞ্জিনগুলোর ব্রেক ঠিকভাবে কাজ করছে না। অনেক যন্ত্রপাতি প্রায় অকেজো হয়ে পড়েছে এবং ইলেকট্রিক ডিভাইসও সঠিকভাবে কাজ করছে না। কোচ ও বগির মধ্যে ময়লা ও দুর্গন্ধ বিরাজ করছে, সিটগুলোও ভাঙাচোরা হয়ে পড়েছে। এককথায়, পুরো ট্রেনবহরজুড়ে অব্যবস্থাপনার ছাপ স্পষ্ট।

অতীত বিনিয়োগ বনাম বর্তমান সমস্যা:

রেলওয়ের জন্য অতীতে কিছু প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল, তবে সেগুলো সফল হয়নি।

• ২০০৯: ৭০টি ইঞ্জিন আনার বড় প্রকল্প বাতিল করা হয়।

• ২০১১: দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১১টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনা হয়েছিল।

• ২০২১: হুন্দাই রোটেম থেকে ৩০টি আধুনিক ইঞ্জিন আনা হয়েছিল।

তবে গত এক বছরে ইঞ্জিন, ব্রেক, সিগন্যাল এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়নি। এর ফলে রেল ব্যবস্থার সংকট আরও গভীর হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা:

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, এই অবস্থা শুধু অব্যবস্থাপনা নয়, বরং রেল ধ্বংসের একটি পরিকল্পিত নকশার ইঙ্গিত দেয়। তারা জানিয়েছেন, যদি দ্রুত নতুন ইঞ্জিন এবং মেকানিক্যাল যন্ত্রপাতি সংগ্রহ না করা হয়, তবে রেলওয়ের নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একে পুঁজি করে রেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা। বিশেষজ্ঞরা আরও বলেছেন, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, দক্ষ জনবল, এবং আধুনিক প্রযুক্তি ছাড়া রেলওয়ে দীর্ঘমেয়াদে টিকবে না।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা:

বর্তমানে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নতুন ৩০টি ইঞ্জিন আনার পরিকল্পনা করেছে, তবে আন্তর্জাতিক বাজারে মিটারগেজ ইঞ্জিনের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে এই প্রক্রিয়া ধীরগতিতে চলছে। এ ছাড়া, অভ্যন্তরীণ অনিয়ম এবং যন্ত্রাংশ না কেনার কারণে সংকট দ্রুত সমাধান হচ্ছে না।

বাংলাদেশ রেলওয়ের সংকট একদিকে যেমন একটি গুরুতর অব্যবস্থাপনা, তেমনি এটি রেলের ধ্বংসের একটি পরিকল্পিত প্রয়াস হিসেবে দেখা যেতে পারে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ দ্রুত নেওয়া না হলে, রেলওয়ের ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকারে নেমে আসবে এবং দেশের পরিবহন ব্যবস্থায় একটি বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে।

লালসবুজ২৪.কম
ইমেইল: info@lalsobuj24.com