লালসবুজ ডেস্ক
প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৫৭ পিএম
দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ের প্রতীক হিসেবে যাত্রা করা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এখন নিজেই বড় ধরনের বিতর্কের মুখে। সংস্থাটির নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগকে ঘিরে উঠেছে ২০০ কোটি টাকার ঘুষ লেনদেনের চাঞ্চল্যকর অভিযোগ। আর এতে জড়িয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টার নাম। সম্প্রতি দেশের একটি গণমাধ্যমের এক রিপোর্টে উঠে এসেছে এমনই ভয়াবহ সব তথ্য।
অভিযোগ অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার মাধ্যমে ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন এই বিপুল অর্থের বিনিময়ে দুদকের চেয়ারম্যান পদ নিশ্চিত করেছেন। গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এটি ছিল তথাকথিত ‘বাকিতে ঘুষ’ লেনদেন- যেখানে ১০০ কোটি টাকা আগাম পরিশোধ করা হয়েছে, আর বাকি ১০০ কোটি টাকা চেয়ারম্যান পদে যোগদানের পর দুর্নীতির মাধ্যমে পরিশোধের চুক্তি হয়েছে।
এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসায় অন্তর্বর্তী সরকারের স্বচ্ছতা এবং ঘোষিত দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ড. মোমেনের অতীত বিতর্ক ও দুর্নীতির আমলনামা-
অনুসন্ধানে দেখা যায়, দুদকের বর্তমান চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের বিরুদ্ধে আগেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকাকালীন সময়ে বড় ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তার কর্মজীবনের কয়েকটি অধ্যায়জুড়ে রয়েছে বিতর্ক।
১. কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানী (CPGCBL)-এর চেয়ারম্যান থাকাকালীন দুর্নীতি:
ড. মোমেন CPGCBL-এর চেয়ারম্যান থাকাকালে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো একটি মেগা প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ঠিকাদার নিয়োগে দুর্নীতি: অভিযোগ অনুযায়ী, তিনি পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিয়ে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। প্রকল্পের ব্যয় কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে এই অর্থ লোপাট করা হয়।
সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ: প্রকল্পের প্রায় ৫ কোটি টাকা মূল্যের তামার তার কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে খোলা বাজারে বিক্রি করে দেন। এছাড়া, প্রায় ৪ কোটি টাকার স্ক্র্যাপ (পুরাতন লোহালক্কড়) কোনো প্রকার নিলাম ছাড়াই বিক্রি করে সম্পূর্ণ অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগও তার বিরুদ্ধে রয়েছে।
২. বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এমডি থাকাকালীন দুর্নীতি ও অনিয়ম:
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে তার কার্যকাল ছিল অত্যন্ত বিতর্কিত।
গণহারে চাকরিচ্যুতি: ২০০৬ সালের পর তিনি বিএনপি-জামায়াত পন্থী কর্মকর্তা-কর্মচারী সন্দেহে প্রায় ২১৭৭ জনকে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করেন বলে অভিযোগ রয়েছে, যা তৎকালীন সময়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।
ঋণের অর্থ আত্মসাৎ: বিশ্বব্যাংক থেকে বিমানের উন্নয়নের জন্য ৩০৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হলেও তার একটি বড় অংশ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে ড. মোমেনের বিরুদ্ধে। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের করা একটি তদন্ত প্রতিবেদনেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ মিলেছিল বলে জানা যায়।
৩. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব থাকাকালীন দুর্নীতি:
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালেও তার বিরুদ্ধে ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে।
বদলি ও পোস্টিং বাণিজ্য: পুলিশ প্রশাসনে বদলি ও পোস্টিংকে কেন্দ্র করে তিনি শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অর্থের বিনিময়ে পছন্দের কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।
৪. দুদকের চেয়ারম্যান হওয়ার পর তিনি মেঘনা গ্রুপ সহ কয়েকটি বড় গ্রুপের অনুসন্ধান করতে দেয় নাই। এছাড়াও আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের পিএস শামসুদ্দীন মাসুমের নামে দুদককে অভিযোগ আসলেও তিনি তার অনুসন্ধান করতে দেয় নাই।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো সংস্থার নেতৃত্বে যদি এ ধরনের অভিযোগযুক্ত ব্যক্তি থাকেন, তা জাতির জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। নিয়োগ প্রক্রিয়াতেই যদি ঘুষের অভিযোগ ওঠে, তবে প্রতিষ্ঠানটির প্রতি জনগণের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
অভিযোগগুলোর বিষয়ে জানতে ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন, আসিফ নজরুল ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কেউই সাড়া দেননি।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা দুদকের এই নিয়োগ কেলেঙ্কারির পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। এখন জাতি তাকিয়ে আছে—অন্তর্বর্তী সরকার এই অভিযোগে কী পদক্ষেপ নেয়।