লালসবুজ ডেস্ক
প্রকাশ: ১১ মে ২০২৫, ০৪:২৫ পিএম
পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান যখন সরাসরি সামরিক সংর্ঘষে জড়িয়ে পড়েছিল, তখন হঠাৎ করেই শনিবার (১১ মে) অনেকটা অবাক করা ঘোষণায় জানানো হয়, তারা তাৎক্ষণিক অস্ত্রবিরতিতে রাজি হয়েছে। অথচ, এর আগের চারদিনে দুই দেশের মধ্যে চলছিল কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র এবং বিপজ্জনক যুদ্ধপরিস্থিতি। এমন উত্তেজনাকর পটভূমিতে অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছে, এত দ্রুত এই বিরতিতে রাজি হওয়ার পেছনে আসলে কী কারণ কাজ করেছে?
এর আগে, ২২ এপ্রিল, কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলিতে কমপক্ষে ২৬ জন নিহত হন। ভারত এর জন্য সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করে এবং ৭ মে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে বড় ধরনের আক্রমণ চালায় পাকিস্তানের অভ্যন্তরে। পাকিস্তানও পাল্টা জবাবে ভারতের সামরিক ঘাঁটিসহ বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায়। যুদ্ধ গড়ায় মাঝ আকাশে এবং দুটি দেশের মূল ভূখণ্ডে—এমন একটি ব্যাপকতায়, যা আগের কোনো সংঘর্ষে দেখা যায়নি।
হঠাৎ অস্ত্রবিরতির ঘোষণা: ১১ মে শনিবার, ভারত ও পাকিস্তান হঠাৎ করেই অস্ত্রবিরতির ঘোষণা দেয়। প্রথমে এটি ঘোষণা করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি বলেন যে, 'দুই দেশের নেতৃত্ব চমৎকার বুদ্ধিমত্তা ও কৌশল প্রয়োগ করে একটি পূর্ণাঙ্গ এবং তাৎক্ষণিক অস্ত্রবিরতিতে পৌঁছেছে।'
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মার্কো রুবিও জানান, দুই দেশের মধ্যে আলোচনা একটি নিরপেক্ষ ভেন্যুতে আরও ব্যাপক ইস্যুতে শুরু করার কথাও নাকি তারা মেনে নিয়েছে।
পাকিস্তান এই প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রকে ধন্যবাদ জানালেও, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জানায় যে, এই সংঘাতের সাময়িক বিরতি হয়েছে দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগের মাধ্যমে, বাইরের কেউ মধ্যস্থতা করেনি।
ভয়াবহ গোয়েন্দা তথ্যের ভূমিকা: তবে সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধবিরতির এই আকস্মিক সিদ্ধান্তের পেছনে কাজ করেছে কিছু ভীতিকর গোয়েন্দা তথ্য। যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শুক্রবার (১০ মে) রাতে যুক্তরাষ্ট্র যে গোয়েন্দা তথ্য হাতে পেয়েছে তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক ছিল। সেই তথ্য থেকে বোঝা যায়, সংঘাত দ্রুততম সময়েই পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধ অথবা সর্বাত্মক যুদ্ধ, এমনকি পরমাণু সংঘর্ষে পর্যন্ত গড়াতে পারে।
সিএনএনের প্রতিবেদনে পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধ উল্লেখ করা হলেও 'পরমাণু যুদ্ধ' শব্দটি কূটনৈতিক কারণে স্পষ্টভাবে ব্যবহার করা হয়নি।
তবে এই বাক্যাংশটি ‘সর্বাত্মক যুদ্ধ’ বা ‘পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কা’কে স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে, বিশেষ করে যখন তা দুটো পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রসঙ্গে বলা হয়।
এই তথ্য পাওয়ার পর, মার্কিন কূটনীতিকরা তাদের অবস্থান বদলে সরাসরি আলোচনায় নেমে পড়েন এবং মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দুই দেশকে একটি অস্ত্রবিরতির চুক্তিতে আনতে বাধ্য করেন।
এই অস্ত্রবিরতির ঘোষণা ঘিরে শুরু হয়েছে নানা দাবি ও পাল্টা দাবি। পাকিস্তান বারবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রশংসা করলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মার্কিন হস্তক্ষেপকে প্রকাশ্যে স্বীকার করতে নারাজ। পর্যবেক্ষকদের মতে, এটি দুই দেশের ভিন্ন কূটনৈতিক অভ্যাসেরই প্রতিফলন।
ভারতের মতো উদীয়মান বিশ্বশক্তি সাধারণত বাইরের হস্তক্ষেপকে অগ্রাহ্য করতে চায়, আর পাকিস্তান আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকে চাপ তৈরির একটি কৌশল হিসেবে দেখে থাকে।
যদিও সাময়িক বিরতির ঘোষণা এসেছে, এর মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দুই পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্রবিরতির লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বলেছেন, পাকিস্তান একাধিকবার চুক্তি ভঙ্গ করেছে। অন্যদিকে, পাকিস্তানও একই অভিযোগ এনেছে, তবে বলেছে তারা অস্ত্রবিরতির প্রতি এখনো 'অঙ্গীকারাবদ্ধ'।
তাছাড়া, এই সংঘাতের প্রতিক্রিয়ায় দুই দেশ যে সব কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিল—যেমন বাণিজ্য বন্ধ, ভিসা স্থগিত, পানি-বণ্টন চুক্তি থেকে ভারতের বেরিয়ে যাওয়া—সেগুলো এখনও প্রত্যাহার হয়নি।
অস্ত্রবিরতির নেপথ্যে এক চাপা আতঙ্ক: শেষ পর্যন্ত, ভারত ও পাকিস্তান কেন এত দ্রুত অস্ত্রবিরতিতে রাজি হলো—তার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হলো: এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতা সম্পর্কে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সতর্কবার্তা। যখন দুই পারমাণবিক শক্তির মধ্যে যুদ্ধ জ্বলন্ত বাস্তবতায় রূপ নেয়, তখন তার সম্ভাব্য পরিণতি কেবল সীমান্তে নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ায়, এমনকি বৈশ্বিক নিরাপত্তায় ভয়ঙ্কর ছাপ ফেলতে পারে। এর আগে, এক গবেষণায় বলা হয়েছে, এই দুই দেশ পারমাণবিক যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে ভারত মহাদেশে প্রায় ১২ কোটি মানুষের মৃত্যু হতে পারে।