গাজায় মানবিক সহায়তা নিতে গিয়ে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৭

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় তীব্র খাদ্যসংকটের মধ্যে মানবিক সহায়তা নিতে গিয়ে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৭১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে এমনটাই জানিয়েছেন গাজার বেশ কয়েকটি চিকিৎসা সূত্র।
একইসঙ্গে গাজায় ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে আরও সাতজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে সেখানকার হাসপাতালগুলো। বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
গাজা সরকারের মিডিয়া অফিস জানায়, বুধবার সহায়তা নিতে উত্তর গাজার জিকিম ক্রসিংয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় অন্তত ৫১ জন নিহত ও আরও ৬৪৮ জনের বেশি আহত হয়েছেন।
দক্ষিণ গাজার খান ইউনুসের কাছে তথাকথিত মোরাগ করিডোর এলাকায় আরও ২০ জন সাহায্যপ্রার্থীকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্স।
চলতি বছরের মে মাসের শেষ দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) পরিচালিত সাহায্য বিতরণ কেন্দ্রগুলোর আশপাশে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় এক হাজারেরও বেশি সাহায্যপ্রার্থী নিহত হয়েছেন।
জিএইচএফ-এর সহায়তা কার্যক্রমে ব্যর্থতা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতির কারণে জাতিসংঘসহ একাধিক মানবাধিকার সংস্থা তাদের কঠোর সমালোচনা করেছে। এই হামলাগুলো এমন সময়ে ঘটছে যখন মানবিক সংস্থা ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে চরম খাদ্যসংকটের আশঙ্কা করছেন।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অপুষ্টিতে ১৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে ৮৯ জন শিশু। বেশিরভাগ মৃত্যু সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ঘটেছে। এক আন্তর্জাতিক ক্ষুধা পর্যবেক্ষক সংস্থা মঙ্গলবার জানায়, গাজায় দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
আল জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জিহান আল-কুরআন নামে এক মা বলেন, “দেখুন আমার মেয়ের পেট! কোনো মাংস নেই, কেবল হাড়। এক মাস ধরে রুটির মুখ দেখিনি।”
তিনি জানান, একটি জনাকীর্ণ স্যুপ রান্নার কেন্দ্রে খাবার নিতে গিয়ে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। তার ভাষায়, “শুধু শুকনো পাস্তা মেঝেতে পড়ে ছিল।”
এদিকে প্রয়োজনীয়তার তুলনায় গাজায় সাহায্যের প্রবেশ এখনও অত্যন্ত কম। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ-র মুখপাত্র আদনান আবু হাসনা আল জাজিরাকে বলেন, “যতটুকু সাহায্য ঢুকছে, তা জনসংখ্যার বেশিরভাগের কাছেই পৌঁছাচ্ছে না।”
জাতিসংঘ বলছে, গাজার ন্যূনতম মানবিক চাহিদা পূরণে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০টি ট্রাকের দরকার। অথচ গত চার দিনে মাত্র ২৬৯টি ট্রাক প্রবেশ করেছে।
আল জাজিরার গাজা প্রতিনিধি তারেক আবু আজজুম বলেন, “এর বেশিরভাগই ক্ষুধার্ত মানুষের ভিড়ে লুট হয়ে গেছে। এখন সহায়তা লুট হওয়াটা আর অবাক করার মতো নয়। দীর্ঘ সময় ধরে খাদ্য, পানি ও চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত মানুষের এমন আচরণ প্রত্যাশিতই ছিল।”
তিনি আরও বলেন, “অনেকে দিনের পর দিন কোনো ধরনের খাবার না খেয়ে কাটাচ্ছেন। যত ট্রাক যাচ্ছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।”
ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটর জানায়, গাজার বাস্তুচ্যুত শিবিরগুলোতে অপুষ্টি ও চিকিৎসার অভাবে বহু বৃদ্ধ মারা গেছেন। সংগঠনটি বলেছে, “স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে স্পষ্ট রিপোর্টিং পদ্ধতি না থাকায় এবং পরিবারগুলো দ্রুত দাফন করে ফেলায় এই মৃত্যুগুলোর অনেকগুলোকে প্রাকৃতিক মৃত্যু হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।”
তারা আরও জানিয়েছে, গত দুই সপ্তাহে হাসপাতালে ও প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্রে মৃত্যু উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। শত শত বৃদ্ধ মানুষ চরম ক্লান্তি নিয়ে পুষ্টিকর তরল খাবার চেয়ে আসছেন।
এছাড়া বুধবার গাজাজুড়ে ইসরায়েলি হামলায় আরও অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে চিকিৎসা সূত্র। এদের মধ্যে গাজা সিটিতে আলাদা দুটি বিমান হামলায় অন্তত তিনজন নিহত হন, যাদের একজন ফিলিস্তিনি ফটোসাংবাদিক ইব্রাহিম মাহমুদ হাজ্জাজ (৩৫)।
কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস বলছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি অভিযানে এখন পর্যন্ত ১৭৮ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৬০ হাজার ১৩৮ ফিলিস্তিনি নিহত ও ১ লাখ ৪৬ হাজারের বেশি আহত হয়েছেন।